অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা এবং সমন্বয়সাধন বলতে কী বোঝায়?
সমন্বয়ন’ ও ‘অন্তর্ভুক্তিকরণ-এই দুটি শব্দের অর্থ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অবশ্য এই দুই শব্দের দ্বারাই প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি করার কথা বোঝানো হয়। যদিও মতাদর্শগত এবং দার্শনিক ভিত্তির দিক থেকে এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
সমন্বয়নের দ্বারা প্রতিবন্ধী শিশুকে একীভূত শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়। এর জন্য সেই শিশুকে সাধারণ বিদ্যালয়ের উপযোগী কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং এই শিশুর পাশাপাশি তার অভিভাবককেও এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন করার চেষ্টা করা হয়।
অপরদিকে অন্তর্ভুক্তিকরণের দ্বারা প্রতিবন্ধী শিশুকে অন্য সাধারণ শিশুদের মতো সরাসরি ৮, বিদ্যালয়ে ভরতি করা বোঝানো হয়। এই আদর্শ অনুসারে প্রতিবন্ধী শিশুদের সমস্ত চাহিদা সাধারণ বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর মধ্যেই পরিপুরণ করার চেষ্টা করা হয়। সাধারণ শিশুদের সমকক্ষ করে বিভানোর জন্য এখানে প্রতিবন্ধী শিশুদেরও অল্প বয়সে বিদ্যালয়ে ভরতি করার কথা বলা হয়। এখানেই সমন্বয়নের সঙ্গে তার পার্থক্য। কারণ অন্তর্ভুক্তিকরণের অর্থ-ই হল সমগ্র শিল্প- পরিকল্পনার সঙ্গে একাত্মীকরণ যার মধ্যে থাকবে বিদ্যালয় গৃহ, আসবাবপত্র, শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ, শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিচালক এবং প্রতিবন্ধী শিশুর চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিশেষ ব্যবস্থা ও পাঠক্রম ইত্যাদি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে পাঠক্রম সংশোধন করতে হয়। অর্থাৎ তাদের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষণ পদ্ধতি, কর্মকৌশল এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি সংশোধন করতে হয়। অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে যে-কোনো মানসিকতা সংক্রান্ত বাধা দূর করার জন্য প্রয়োজনীর বন্ধনমুক্ত পরিবেশ এবং ন্যূনতম নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে
শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হয়। সবশেষে বলা যায়, সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ ও প্রতিবন্ধী শিশু-উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য
অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে |
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষক, পিতা-মাতা, প্রশাসন ও সমাজের ভূমিকা
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা;
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা হল এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিশুদের পাশাপাশি শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়। বলা বাহুল্য, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যে বিশেষ দায়িত্বগুলি পালন করতে হয়, সেগুলি হল-
(a) পাঠ্যক্রম পরিমার্জন:
বাস্তব প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে কখনো-কখনো শিক্ষককে তার নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমের মধ্যে কিছু কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে হয়। এক্ষত্রে শিক্ষকের নমনীয়তা, বিচার-বিবেচনাবোধ, বাস্তববোধ প্রভৃতি বিশেষ প্রয়োজন।
(b) অভিভাবকদের সঙ্গে সংযোগ:
এ কথা সত্যি যে, শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্রচেষ্টার দ্বারাই প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। তাই অভিভাবকদের সচেতনতা ও প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাম্য। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতা বা পশ্চাদপদতা অথবা শিক্ষাক্ষেত্রে অনুসৃত বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে অভিভাবকদের ধারণা দেওয়া শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
(c) বিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগ
(c) বিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি অথবা বিশেষ কোনো সমস্যা এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত কোনো উপাদান বা ব্যবস্থাদির প্রয়োজন হলে, শিক্ষকের দায়িত্ব হল বিদ্যালয়ের প্রশাসনের দৃষ্টিগোচরে নিয়ে আসা।
(d) উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি:
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যাতে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় বিশেষ সুযোগসুবিধা পায়, স্বাভাবিক শিশুরা যাতে তাদের প্রতি ব্যঙ্গবিদ্রূপ না করে এবং সর্বোপরি শ্রেণিকক্ষে যাতে শিখন সহায়ক পরিবেশ বজায় থাকে সেদিকেও শিক্ষকের নজর রাখা উচিত।
(c) পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি:
সদর্থক মনোভাব নিয়ে শিক্ষককে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার ১৩ বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে হয়। এ ছাড়া কর্মরত অবস্থায় তাঁকে মাঝে মাঝে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় পিতা-মাতার ভূমিকা:
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার সঠিক রূপায়ণে প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিভাবকদের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। এগুলি হল- EMY
(ক) শিশুকে বিদ্যালয়ে ভরতির সময় প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে সঠিক তথ্যের উল্লেখ করা।
(খ) সন্তানের বিশেষ চাহিদা সম্পর্কে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অবহিত করা।
(গ) সন্তানের প্রতিবন্ধিতার ধরন ও মাত্রা এবং তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শিক্ষকদের অবহিত করা।
(ঘ) নিয়মিতভাবে শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা।
(৫) বিদ্যালয় ছুটির পর অথবা বিদ্যালয় আরম্ভ হওয়ার আগে বাড়িতে সন্তানের কাজকর্ম সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেওয়া।
(চ) সন্তানের অগ্রগতি বা দুর্বলতার দিকগুলি সম্পর্কে শিক্ষকদের সঠিক তথ্য সরবরাহ করা।
(ছ) শুধুমাত্র বিদ্যালয় বা শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল না থেকে বাড়িতেও শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা।
জ) নিজের সন্তানের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিবন্ধী ও স্বাভাবিক সহপাঠীদের প্রতিও সহানুভূতির মনোভাব পোষণ করা।
(ঝ) বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহায়তা করা।
(ঞ) বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করা।
(ট) পড়াশোনার পাশাপাশি সন্তানকে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলিতে উৎসাহিত করা।
(ঠ) প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি চিকিৎসকের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা এবং চিকিৎসকের বিশেষ পরামর্শ সম্পর্কে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় অভিভাবকের অংশগ্রহণ একটি অমূল্য বিষয়। অভিভাবক ও শিক্ষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সময়, শ্রম প্রভৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে একটি প্রতিবন্ধী শিশু সঠিক দিক নির্দেশ পেতে পারে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা:
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। মূলত এই ধরনের শিক্ষার বাস্তবায়নের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করে বিদ্যালয় প্রশাসন। সাধারণ বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের একত্রে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে সকল বাধা অতিক্রম করার দায়িত্ব বিদ্যালয় প্রশাসনের। প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাগুলি হল-
(ক) অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুদান সরকার বা স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জোগাড় করা।
(খ) প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা।
(গ) বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের স্বল্পকালীন বিশেষ শিক্ষার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
(ঘ) বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে এই শিক্ষা বিষয়ে পর্যালোচনা করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও গুরুত্ব তুলে ধরা।
(ঙ) বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ভিতরে ও বাইরে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগত উন্নতির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া।
(চ) শিক্ষকদের শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের জোগান দেওয়া।
(ছ) প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে পাঠ্যক্রমের প্রয়োজনীয় সংযোজন ও বিয়োজন করা।
(ড) বিদ্যালয়ের সমস্ত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধিতার ধরন ও মাত্রা নির্ধারণের জন্য উপযুক্ত চেক-আপ ক্যাম্পের আয়োজন করা।
(ঝ) শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক ও অভিভাবিকাদের নিয়ে মাঝে মাঝে সাধারণ সভার অয়োজন করা।
(ঞ) প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ও তাদের অভিভাবকদের শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় সমাজের ভূমিকা:
প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। পরিবার তথা সমাজই পারে একজন প্রতিবন্ধীকে আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে। সমাজের কয়েকটি ভূমিকা হল-
(a) সমাজের প্রতিটি সুনাগরিককে প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় এদেরকে অন্তর্ভুক্তকরণে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
(b) বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে মত বিনিময় করতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সুপরামর্শ দিতে হবে।
(c) বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়াকর্মে প্রতিবন্ধীদের নিয়োজিত করে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে।
(d) বিদ্যালয়ে সহপাঠী প্রতিবন্ধী বন্ধুদের প্রতি যাতে সহযোগিতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এবিষয়ে নিজেদের স্বাভাবিক সন্তানদের সুপরামর্শ দেবেন।
(e) বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পিতা-মাতার পাশে দাঁড়াতে হবে।
সমাজের যে সমস্ত প্রতিবন্ধী শিশু এখনও বিদ্যালয়ে যায়নি অথবা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, তাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় ভরতি করতে হবে। (g) সমাজে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রতিবন্ধী শিক্ষাদ্ধাদের পুরস্কৃত করে তাদেরকে উৎসাহিত ও আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে।